রবিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৫

বৈশাখ ও বিবস্ত্র নারী

শালীনতা কী আসলে? এর কি কোন নিয়ম আছে? এক কথায় বলতে গেলে শালীনতা হল আসলে মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি। মানুষের পোষাক-পরিচ্ছেদ, আচার-ব্যাবহার এর সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট অলিখিত একটি নিয়ম। এটি আসলে সারা পৃথিবীতে এক নয়। পৃথিবী ব্যাপী এটি ভিন্ন রুপ প্রদর্শন করে। যেমন ধরা যাক আমেরিকা অথবা ইউরোপ এ কোন মহিলা যদি অর্ধ নগ্ন হয়ে হাটে তবে সেটিও তাদের শালীনতা এর স্কেল এ শুদ্ধ। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে তা সম্ভব নয়। আবার যদি আরব দেশগুলোতে যদি কেউ এরকম করে তবে তাকে হয়ত জেলেও যেতে হতে পারে।আবার পুরুষের ক্ষেত্রেও নানা নিয়ম রয়েছে।
  আজ শালীনতা শেখানোর জন্য লিখতে বসিনি। আজ বর্তমান সময়ে সকলের আগ্রহের ঘটনা -টিএসসি কেলেঙ্কারি নিয়ে লিখব। সবাই আসলে খুবই উৎসুক এ ব্যাপারে কিছু বলার জন্য অথবা কারো কাছ থেকে শোনার জন্য। আমাকেও কয়েকজন এ ব্যাপারে আমার অভিমত জানতে চেয়েছে। আমি হেসে একটাই উত্তর দিয়েছিলাম, আমি সেই মেয়ে গুলোর পোষাককে দায়ী করব না। আবার আমি সেই অধম এর সন্তানদেরও দোষারোপ করব না। তাহলে আমরা একটু খুঁড়ে দেখি ব্যাপারটা কাকে আসলে দোষারোপ করা যায়।
     কাউকে দোষ দেওয়ার আগে ঘটনাটার বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে প্রতিবারের মত এবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা উৎসব মুখর ছিল। সকাল থেকে দলে দলে নারী-পুরুষ এদিকে সেদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে একদল ছেলে একটু ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়েই জড়ো হয়েছিল। তারা ছিল খুবই সঙ্ঘবদ্ধ। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মহিলাদের উত্যক্ত করা। বিশেষ করে যৌন হয়রানি এবং বিবস্ত্র করাই ওদের উদ্দেশ্য ছিল। বলতে গেলে তারা অনেকটা সফল ছিল। গেইট এর দিক থেকে কোন মহিলা বেরিয়ে এলেই তারা আস্তে আস্তে জড়ো হয়ে তাকে তার স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর সবার সামনেই তাকে নানা ভাবে হয়রানি করে। টিএসসি এলাকার সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত লিটন নন্দি এর প্রথম আলোতে বলা বিবরণ এ এর সুন্দর উদাহরণ পাওয়া যায় (প্রথম আলো ২০/০৪/২০১৫)। তিনি কয়েকজন মেয়েকে বাঁচান এতে কিল-ঘুষিতে তার হাত ভেঙে যায়। পুলিশ নির্বাক দর্ষক এর ভূমিকা পালন করে। অনেক মহিলা লাঞ্চিত হয় আবার অনেকে লিটন নন্দির মত কিছু মানুষের কল্যানে বেঁচে যায়। মোটামুটি এই ছিল সেই দিনের ঘটনা।
    শুরুতেই খানিকটা শালীনতার জ্ঞান দিয়েছিলাম। কারনও একটা ছিল। কারন এই ঘটনার পর আমাদের দেশের অনেক লোক মেয়েগুলার পর্দা নিয়ে মন্তব্য করেন বা এখনও করছেন। আবার অনেকে এদের বিরুদ্ধে গিয়ে বলছেন যে পর্দার চেয়ে চোখের লজ্জা জরুরী।  আমার মতে আসলে দুটোই ঠিক। ঠিক তবে আংশিক আবার এ ক্ষেত্রে একেবারেই ঠিক নয়। যারা এসব মন্তব্য করছেন তারা তাৎক্ষণিক উৎপন্ন হওয়া ক্ষোভ থেকে বলছেন। গভীরভাবে ভাবলে অন্য কিছু বেরিয়ে আসবে।
    পহেলা বৈশাখ উৎসব পালন সম্পর্কে আমি সব সময়ি অনিচ্ছুক। আসলে পহেলা বৈশাখ নিয়ে আমার সমস্যা নেই। এর উৎসব পালনের ধরন নিয়ে যত ঝামেলা। যাহোক সেটা আলোচ্য বিষয় নয়। যদি আমি সেইদিনের সেই ছেলেগুলোকে ঢালাউভাবে দোষ দিতে যাই তাতে কিছুটা সমস্যা আছে। ওরা তো আসলে.... কোন অপরাধ করেনি। কারন পুলিশের মুখপাত্রের মতে ঐদিন সেখানে কোন বস্ত্রহরণ এর ঘটনাও ঘটেনি। উপরন্তু জনতা যাদের পুলিশের হাতে দিয়েছিল, বিশেষ(!) সংগঠন এর লোক হওয়ায় পুলিশ তাদের চা-নাস্তা খাইয়ে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছে। আবার যদি আমরা পুলিশের সেই মুখপাত্রকে পাগল বিবেচনা করে ধরে নেই যে সেদিন সেখানে বস্ত্রহরণ এর ঘটনা ঘটেছিল তবুও তাদের দোষ নেই। কৌতূহল জাগছে কি? আচ্ছা যদি কোন বাচ্চা স্কুলে গিয়ে অথবা বাসায় সবার সাথে ভিন দেশী ভাষায় কথা বলে তবে আমরা দোষ দেই ভিনদেশী কার্টুন চ্যানেল এর। কিন্তু বাচ্চাগুলোর অভিভাবক সচেতন হলে তারা আর সেই চ্যানেল দেখতে পারত না। ঠিক একই ভাবে আমাদের বর্তমান অবস্থা থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে তাই সেই ছেলেগুলো শিখছে। সারাদিন তারা যদি শীলাকি জাওয়ানি, সানি লিওন ও পর্ণ মুভি দেখে তবে তাদের কাছ থেকে আপনি ভাল ব্যবহার আশা করাটাই অন্যায়। আর আমরা চাইলেই যেটা করতে পারতাম তা হল সেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে রুখতে পারতাম। হায় তা হয়নি। আজ তাই পথেঘাটে শোনা যায় সেই তেরি-মেরি গানগুলো যেখানে মানুষ আগে মনির খান, সুবির নন্দিদের গান গাইত।আবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে তো এইসব ছেলে তৈরির কারিগর বললে ভুল হবে না। সেখানে বড়ভাইদের কাজ করে দিলে উপহার হিসেবে দেওয়া হয় গাঞ্জা, হেরোইন, মদ সহ আরো কত উপঢৌকন।  তাই আমি সেই ছেলেগুলোকে দোষ দেই না।
  আবার অনেকে মেয়েগুলোর পোষাক এর ব্যাপারে বলছিলেন। আরে ভাই পোষাক এর কথা বলছেন কেন? ঐ মেয়েগুলো তো আমাদের সমাজে প্রচলিত তথাকথিত শালীনতা(!) মেনেই ছিল। আর পহেলা বৈশাখ এর মত এত বড় জাতীয় উৎসবে যদি ওনারা অংশগ্রহণ না করেন, একটু পান্তা-ইলিশ না খান তবে কি চলে! তারা নারী হয়েছে তো কি হয়েছে? সমান অধিকার ওনাদের আছে। আর ভাই আপনারা যে মহিলাগুলোকে দোষ দিচ্ছেন আপনাদের ভাবা উচিৎ যে ওনারা সেই উৎসবে না আসলে সেই ভাইয়্যারাও আসতেন না। আর ওনারা ভিনদেশী সেই চ্যানেলগুলোতে দেখা যে কাপড়গুলো কিনে থাকেন(কিনে না দিলে তো আবার আত্মহত্যা করতে পারেন) সেগুলোর শো-অফ করার একটা ব্যাপার সেপার আছে। তাই আমি তাদের ও দোষ দেই না।
   তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে আমি দোষ দেই কাকে! কেন আমাদেরকেই। আমরাই তো আমাদের কপালে এই দুর্ভোগ ডেকে এনেছি। আমরাই তো পহেলা বৈশাখের নামে নানা অসামাজিক কাজ করি। আমরাই তো আমাদের মা-বোনদের ঘর থেকে বের হওয়ার পথ দেখাই। আমরাই তো ভিনদেশী কু-সংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে তাদের মত(আসলে হায়েনা ব্যবহার করলে ভাল হত মনে হয়) ছিড়ে-খাবলে খেতে চাই নারী নামের বস্তুগুলোকে। আমাদের মিডিয়াকেও আমি দোষ দেই। তারা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এর বদলে ধার করা সংস্কৃতি ধারন করতে বলে। আমি দোষ দেশের শাসক সমাজকে। তারা চাইলেই এগুলো অনেক আগেই নজর দিতে পারত।
মিডিয়ার কথা বলতে গেলে একটা কথা মনে পড়ে। একবার আমার এক কাছের বন্ধু সহ এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে বড় বড় বিলবোর্ড এ গ্রামীণ ফোন এর অ্যাড। সেখানে মেয়েদের দেখানো হচ্ছে জিন্স প্যান্ট ও টপস এ। আমি বন্ধুকে বললাম, দেখ ওরা কি করতে চাইছে? সে বলল, তুমি অবাক হচ্ছ কেনো! ঢাকায় মেয়েরা এখন এরকম ড্রেসই পড়ে। আচ্ছা তাহলে আমার কথা হল ঢাকার মাত্র কয়েক হাজার মেয়ে কি বাংলাদেশের সব নারীর প্রতিনিধিত্ব করে? করে না। কিন্তু আমাদের মিডিয়া আমাদের উদ্বুদ্ধ করছে সেগুলো গ্রহণ করতে। বাধ্য করছে অতি আধুনিক(!) সমাজের সাথে চলার জন্যই কিছু ভিনদেশী সংস্কৃতি গ্রহণ করতে। আর আমরা গোগ্রাসে তা গিলে খাই, হজম করি।
  আজ অনেকে টিএসসি এর এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় করছেন। অনেকে পশু ইতর ইত্যাদি বলে গালি দিচ্ছেন সে ছেলেগুলোকে।  আচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তো প্রতিবছর এরকম ঘটনা ঘটে তখন আপনারা কই থাকেন? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর এক ছাত্র ধর্ষণ এ সেঞ্চুরি করে। আবার তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানজনক চাকরি দেওয়া হয়। তখন আপনি বা আপনারা কোথায় ছিলেন? আমার মনে হয় উঠ পাখির মত মাটিতে মাথা গুজে চুপ করে ছিলেন।
.
.
এ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত এবং লিখার অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য বন্ধু নাতিফ বিল হককে (siam) আন্তরিক ধন্যবাদ।

মুহাম্মদ আরিফ
২৬/০৪/২০১৫